রাজধানী বনশ্রীর সি ব্লক দিয়ে রামপুরার দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা সাল্লাহউদ্দিন বাবু (৪৭)। মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) দুপুরে মেরাদিয়া থেকে রামপুরা পর্যন্ত অটোরিকশা নিয়েও মাঝপথে এসে সেটি ছেড়ে দিয়েছেন। যানজটে থামকে আছে গোটা এলাকার অলিগলি। রিকশায় বসে সময় নষ্ট করার ফুরসত নেই।
কিছুটা বিরক্ত হয়েই এই প্রতিবেদককে তিনি বললেন, ‘আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে উঠলেও বনশ্রী এখন আর সেই চরিত্র ধরে রাখতে পারেনি। স্কুল, মাদরাসা, রেস্তোরাঁ, হাসপাতালসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভরে গেছে এলাকাটি। সবকিছু করা হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। এতে বসবাসের পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে।’
বিশেষজ্ঞদের দাবি—কেবল বনশ্রীই না, অভিজাত এলাকা হিসেবে খ্যাত ধানমণ্ডি, গুলশান, বারিধারা ও বনানীও হারিয়েছে আবাসিক চরিত্র। মোহাম্মদপুর আর ওয়ারী এখন ঘিঞ্জি এলাকা। ঢাকার আবাসিক এলাকাগুলোর খুব কম ভবনই আছে, যেটা শুধু আবাসিক।
তারা বলেন, আবাসিক এলাকা মানুষকে অনেক কিছু দেয়। শুধু ঘুমানোর জন্য আবাসিক এলাকা না, সেখানে মানুষের থাকার জন্য মৌলিক প্রয়োজনগুলো থাকতে হবে, হতে হবে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যবান্ধব। আবার আবাসিক এলাকায় নতুন ভবন নির্মাণে বেশি শব্দ করা যাবে না, বেশি জোরে মাইক বাজানো যাবে না। পানি ও পয়োঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থাটা থাকতে হবে যথাযথভাবে।
আরও পড়ুন: ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সড়কের উন্নয়ন কাজ আটকে যাওয়ায় জনভোগান্তি চরমে
কিন্তু ঢাকার আবাসিক এলাকাগুলোতে এসবের কিছুরই বালাই নেই অভিযোগ করে আসছেন নগর ও পরিবেশবিদরা।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) কোষাধ্যক্ষ আমিনুল ইসলাম সুজন সেই কথাই বলছিলেন এই প্রতিবেদককে। তিনি বলেন, ‘রাজধানীর অনেক আবাসিক এলাকা মিশ্র ও বাণিজ্যিক হয়ে গেছে। যেমন, ধানমন্ডি। এটির মিশ্র মিশ্র ব্যবহার হচ্ছে। এটাকে এখন আর আবাসিক এলাকা বলা যাচ্ছে না।’
‘আশির দশকের শুরুর দিকে গড়ে উঠতে শুরু করে রাজধানীর উত্তরা। এখানের কোনো কোনো এলাকা, বিশেষ করে মূল রাস্তা থেকে দূরের এলাকাগুলো আবাসিক আছে। দিয়াবাড়িতে কিছু এলাকা আবাসিক হিসেবে গড়ে উঠছে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার কোনো কোনো এলাকা মিশ্র, কোনো কোনোটা আবাসিক,’ যোগ করেন তিনি।
এই পরিবেশবিদ বলেন, ‘আগে বাণিজ্যিক এলাকা বলতে মতিঝিল ও দিলকুশাকে বুঝতাম। এখন বিভিন্ন আবাসিক এলাকার কাছেও বাণিজ্যিক এলাকা গড়ে উঠছে। যেমন গুলশান—এখানে মূল সড়কের কাছাকাছি এলাকা বাণিজ্যিক। ফলে এটাকে পুরোপুরি আবাসিক এলাকা না বলে মিশ্র বলা যায়। আবার, বারিধারার ডিওএইচএস এখনও আবাসিক এলাকা আছে।
মানুষের প্রয়োজনের কারণেই আবাসিক এলাকা মিশ্র ও বাণিজ্যিক হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
কেমন হওয়া উচিত আবাসিক এলাকা?
কেবল মানুষ ঘুমানোর জন্য কোনো এলাকাকে আবাসিক এলাকা নামে আখ্যা দেওয়া যায় না বলে জানান সুজন। তিনি বলেন, ‘এসব এলাকার কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। মানুষের মৌলিক প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণের সুযোগ থাকতে হবে। যেমন: খাবার ও ব্যবহার্য পানি, রান্নার জন্য গ্যাস/জ্বালানি, স্যানিটেশন/পয়ঃনিষ্কাশন, বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা (স্যুয়ারেজ), বিদ্যুৎ, প্রয়োজনীয় গাছপালা ও উন্মুক্ত স্থান—এগুলো মানসম্মতভাবে থাকতে হবে।’
‘মানুষের বিনোদন, শরীর চর্চা, খেলাধুলার সুযোগ থাকতে হবে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি (চাল-ডাল-তেল-লবণ, শিশুখাদ্য ও ওষুধ) নাগালে পাওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। আবাসিক এলাকা থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়), কর্মস্থল (ব্যবসা বা শিল্প প্রতিষ্ঠান) বা অন্যত্র যাতায়াতের ব্যবস্থা থাকতে হবে। আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনায় বিদ্যমান বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন করে সেখানকার স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তবেই আমরা একটি পরিপূর্ণ ও মানসম্মত আবাসিক এলাকা পেতে পারি,’ যোগ করেন এই পরিবেশবিদ।
সুজন বলেন, ‘ঢাকায় মানসম্মত আবাসিক এলাকার ঘাটতি প্রকট। সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতা ও জবাবদিহিতার অভাবকে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসাবে দেখি। এক্ষেত্রে রাজউক-এর ব্যর্থতাকে মুখ্য বলে মনে করি। একইসঙ্গে রাজউক, সিটি উত্তর ও দক্ষিণ করপোরেশন, ঢাকা ওয়াসা, ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেশন অথরিটি (ডিটিসিএ), পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয় জরুরি।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘হোম হচ্ছে সুইটহোম। সুইটহোম আবাসিক এলাকার একটা চরিত্র থাকে। দিনশেষে যখন এলাকায় ফিরবেন, তার একটি আবাসিক চরিত্র থাকতে হবে। সেটা আপনাকে অগ্নিকাণ্ড থেকে শুরু করে কোলাহল—সব ধরনের উৎপাত থেকে সুরক্ষা দেবে।’
আরও পড়ুন: ধানমন্ডিতে আবাসিক ভবনে অগ্নিকাণ্ডে আহত ৩